বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটভূক্ত দলগুলোর বন্ধন দীর্ঘদিন ধরেই আলগা ছিল। বহুদিন তাদের একসঙ্গে কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। আগে জোটের নিয়মিত বৈঠক হতো, কিন্তু বছর দুয়েক ধরে সেটিও বন্ধ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দল জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। তাদের একটা অংশ নিয়ে কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে জোটের সংখ্যা ঠিক রাখা হয়েছিল।

 

এই জোটের ভাঙন অনেকটাই অনিবার্য ছিল। শেষতক জোট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জোটের ভাঙাগড়ার খেলায় আওয়ামী লীগ উৎফুল্ল হলেও বিএনপি ভাঙন থেকেও রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে শরিকদের ২০ দলীয় জোটের অস্তিত্ব বিলিনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে শরিকদের ‘জোট’ গঠন করে কিংবা ‘একক’-যেভাবেই হোক যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে জোটে থাকা ১২টি রাজনৈতিক দল নতুন করে একটি ‘ফ্রন্ট’ গঠন করছে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে নতুন ফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ হয়।

১২ দলীয় এই জোটে রয়েছে মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর), মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল, কে এম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি, শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এলডিপি, জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি।

এছাড়া জোটভুক্ত ৬টি দলও আলাদা জোট গঠনের চেষ্টা করছে। তবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি এককভাবে কর্মসূচি পালন করবে। সবগুলো দল একটা জায়গায় ঐক্যমত। তথা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করবে।

জোটের একাধিক নেতা বলেছেন, যুগপৎ আন্দোলন বেগবান করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ১২টি রাজনৈতিক দল।
জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর ভাগাভাগি হয়ে আলাদা জোটভুক্ত হওয়ার বিষয়ে বিএনপির সায় আছে। এর কারণ, যেহেতু বিএনপি কৌশলগত কারণে ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে আর কার্যকর রাখছে না, তাতে ছোট দলগুলো একা হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমমনা এতগুলো ছোট দলের সঙ্গে বিএনপির পক্ষে আলাদা বৈঠক করা বা যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির বিষয়ে সমন্বয় করাও কঠিন হবে। বরং দলগুলো পৃথক জোটভুক্ত হলে তাদের সঙ্গে বিএনপির সমন্বয় করা সহজ হবে। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকটি শরিক দলসহ বাম প্রগতিশীল ধারার মোট সাতটি দল নিয়ে ইতিমধ্যে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠন হয়েছে। এই গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সমন্বয়ের জন্যও লিয়াজোঁ (সমন্বয়) কমিটি হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, কৌশলগত কারণে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যা শরিকদের অবহিত করা হয়। তবে তারা যে যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকবে। মূলত সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপির অবস্থান রয়েছে। এজন্য অন্য শরিকদের বলা হয়েছে তারাও যুগপৎ আন্দোলনে যেন অংশ নেয়। সেক্ষেত্রে কয়েকটি দল মিলেও পৃথকভাবে মোর্চা গঠন করে একসঙ্গে মাঠে থাকতে পারেন। সে পথেই যাচ্ছে। এতে করে সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে সব দলকেই পাশে পাওয়া যাবে।

সূত্রমতে, মূলত ডান-বাম ও ইসলামী দলগুলোকে এক কাতারে এনে যুগপৎ আন্দোলন চায় বিএনপি। এক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোট হিসাবে সামনের যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিলে জামায়াত বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। তাই ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা শরিকদের জানিয়েছে বিএনপি। এখন জামায়াত বাইরে থেকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও তাতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল কোনো অন্তরায় মনে করছেন না বলে জানান বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক।

তারা বলেন, তাদের মূল লক্ষ্য প্রথমত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবি আদায়, দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারের পতন; এবং তৃতীয়ত, সুষ্ঠু নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এলে রাজপথে থাকা সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন।

প্রসঙ্গত, চারদলীয় জোটের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দল এবং পরে পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি দল নিয়ে ২০ দলীয় জোট গঠিত হয়। ডানপন্থি ও মধ্য-ডানপন্থি দলগুলোর সমন্বয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী এ জোট গড়ে উঠেছিল।